এই লেখা মানবিক যৌনতাকে ঘিরে আজকাল যে যে বিতর্কগুলি গড়ে উঠেছে, গজিয়ে উঠেছে তার একটি বিশেষ পরিসরকে নিয়ে। মানুষের বিভিন্নরকম যৌন আচরণ কতটা প্রাকৃতিক (পড়ুন স্বাভাবিক) আর কতটা অ-প্রাকৃতিক, তা নিয়ে। এই লেখায় আমরা মানবিক যৌনতাকে বহুবচন হিসেবে ধরে নিয়েছি, মানুষের যৌন আচরণের বহুত্বকে (সমকামী, বিসমকামী, রূপান্তরকামী ইত্যাদি) সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। ... ...
পায়ে পায়ে মিছিল এগিয়ে চলেছে, কলকাতার রাস্তা দিয়ে। হাজরার মোড় থেকে কালীঘাট হয়ে দেশপ্রিয় পার্ক। প্রায় তিনশো জন নারী, হাতে মোমবাতি, মুখে স্লোগান - ""৮ই মার্চ দিচ্ছে ডাক পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক''। এই বছর, ২০১০ সালে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একশো বছর পূর্ণ হল। ঐ মিছিলের শেষের দিকে কিছু অল্পসংখ্যক মেয়ে, তারা বয়ে নিয়ে চলেছে রামধনু পতাকা। গলা মেলাচ্ছে মিছিলের বাকি মেয়েদের সঙ্গে। কিন্তু মাঝে মাঝে ওরা আরো বলে উঠছে - ""তোমার আমার অংশীদারী, সমকামী তবুও নারী''। সেই সুরে সুর মেলায় মিছিলের শেষের দিকের সকল নারী। রাস্তার দু'ধারের মানুষেরা অবাক চোখে দেখতে থাকে সবাক সমকামী নারীদের। মিডিয়ার ক্যামেরার বিশেষ নজর কাড়ে ওরা। ... ...
আইডেন্টিটি বা পরিচয় কী? সমাজের দ্বারা নির্ধারিত না জৈবিক, নাকি দুইয়ে মিলেই, নাকি আরও অন্য কিছু? ম্যাকক্লস্কির ক্ষেত্রে সমাজ বা বায়োলজি, এ দুইয়ের বাইরে পরিচয় নির্ধারণের আরো একটা জায়গা রয়েছে, যা তাকে বলে দেয় কোনটা তার "আসল' পরিচয়। ম্যাকক্লস্কি স্বীকার করেন না যে মানুষের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট পরিচয় গাঁথা আছে যাকে বের করে আনাই মানুষের একমাত্র নিয়তি, বরং পরিচয় মানুষের স্বাধীনতার ফসল, যা সে নিজের পছন্দমত গড়ে নিতে পারবে। ম্যাকক্লস্কি বার বারই জৈবিক লিঙ্গ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শরীরের আর পাঁচটা অঙ্গের তুলনা দিয়ে থাকেন। কিন্তু কারুর চোখ কটা হলে সেটা তো তার গোটা সমাজের সাথে সম্পর্ক স্থির করে দেয় না, যেমনভাবে দেয় তার লিঙ্গ পরিচয়, ফলে এই তুলনাগুলো কিছুতেই মানুষের অর্ডারের ধারণাকে টলাতে পারে না। ... ...
পৃথিবীতে এক একজন মানুষ থাকেন যাঁদের অতি দূরত্বেও থাকেনা কোনো পরিত্রাণকারী। সময়ের উপর্যুপরি প্রহারে যখন পিঠ ঠেকে যায় অন্তিম দেওয়ালে, তখন স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তাকে তার মত করে ফুঁসে উঠতে হয়। বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়তে হয় প্রহারকের ওপর। সে প্রহারক ব্যক্তিবিশেষই হোক বা সমাজ! ... ...
আগে ভাবতাম আমার সুশিক্ষিত বাবা আমার সমকামিতা মেনে নেবে। কিন্তু আমার আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মা কে বোঝতে বেগ পেতে হবে। কিন্ত আসল ঘটনাটি একদম বিপরীত। স্কুলে থাকাকালীনই সমকামিতা আমাদের সমাজে স্বীকৃত নয় একটা পারিবারিক আলোচনাতে বাবা বলেছিল। আমার সিরিয়াল-প্রিয় মা তত দিন 'দোস্তানা', 'মেমরিস ইন মার্চ', দেখে ফেলেছে। আর তখন একটি হিন্দি জনপ্রিয় সিরিয়ালে (মর্যাদা/মরয়াদা, ইন্দ্রানী হালদার ছিলেন) অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল সমকামী। এবং মায়ের চরিত্রটির জন্য বেশ সহানুভূতি ছিল। সে দিনই বুঝেছিলাম মা তার সন্তানকেও বুঝবে। হ্যাঁ মা বুঝেছে। ... ...
আমি তখন যুদ্ধক্ষেত্রে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। পায়ের একদিক থেকে রক্ত ঝরে যাচ্ছে তখনো, তবে বেশ কমে এসেছে। বাঁধন দিয়েই আটকেছিলাম। চারপাশে শুধু মানুষের স্তুপ। তার মধ্যেই আমার মত কয়েকজন ছটফট করছে। কারোর হাত, কারোর পা, কারোর মাথা চোট পেয়েছে। আর বাকি যারা পড়ে আছে, উঠছেনা, তারা সব মৃত মানুষ। মাঠটার চারপাশে কিছু গাছ ছিল। গাছগুলোতে এখন পাখির দল কিচমিচ করছে। মানে সন্ধ্যা হয়ে এল। এছাড়া সন্ধ্যা বোঝার উপায় এখনো নেই। আকাশটা লালচে হয়ে আছে। কনে দেখা আলো না কী বলে যেন! বেশ কিছু লোক হাতে গড়া মাচা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ... ...
না। এসব কিছুই নয় আসলে। আমরা জানি রাষ্ট্র যা কিছুকে বাঁধা যায় না তাকেই ভয় পায়। নিজে ভয় পায় বলেই ভয় দেখাতেও চায়। ৩৭৭ ধারা আসলে একটা জুজু, তাকে দিয়ে শাস্তি বিধানের তুলনায় ভয় পাওয়ানোর কাজটা হয় বেশি। এতো ফাঁপা আইন দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না আমাদের, আমরা যারা কামকে ভয় পেতে শিখিনি, যৌনতাকে লাভের জন্য ব্যবহার করতেও শিখিনি, আমরা যারা যার যার মায়ের কাছে ‘খারাপ মেয়ে’ হয়েছি নানা সময়, নানা কারণে। আমরা জানি এশুধু কয়েক মাস বা বছরের অপেক্ষা, আইন বদলাবেই। যা নিয়ে ভাবছি তা অন্য – যেদিন রাষ্ট্র সমকামী মানুষের অধিকার মেনে নেবে বা নিতে বাধ্য হবে, সেদিন যত ক্যুয়ার, বক্র, নচ্ছার, সমকামী-মূল-স্রোতের বাইরে থাকা জটিলারা তাদের মতো জায়গা পাবে তো? ... ...
মুসলমানের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে নামাজ পড়াতে মিমিক করবার মজা পাওয়া যায়না, হোমোসেক্সুয়াল দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলে গে-কে ভেঙানো যায়না - ঠিক যেমন আমাদের অজস্র প্রাচীন বাংলা জোকস-এর ভেতর (বি:দ্র: গোপাল ভাঁড়) চণ্ডাল, ডোম প্রভৃতিদের নিয়ে একটিও গল্পকথা খুঁজে পাবেন না, সব হাস্যরসের চরিত্র-ই ইনক্লুডেড যাঁরা, তারা-ই। আর যখন-ই এক্সক্লুশন - এড়িয়ে চলা, ঘেন্না, বিরক্তি এগুলো প্রবলতর হয়ে পড়ে, তখন ঐ হাস্যরস নির্মাণের জায়গাটা চলে যায়। ... ...
প্রথমত আদালত জানাল যে লিঙ্গভিত্তিক যে সাম্যের অধিকার সংবিধান দিয়েছে, যৌনতা বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন তার আওতায় আসবে না (দিল্লি হাইকোর্টের ভাবনা ভিন্ন ছিল)। এখানে ভাবা দরকার যে, সংবিধানে কেন লিঙ্গভিত্তিক সাম্যের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। একথা অনুমান করা কষ্টকর নয় যে সংবিধান প্রণেতারা বুঝেছিলেন, সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আছে, তাই তার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের দরকার রয়েছে। একই রকম ভাবে আমাদের সমাজে যৌনতাভিত্তিক অসাম্যও রয়েছে, কিন্তু আদালত দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো রক্ষাকবচ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তারা বলে দিলেন যে যৌনতা সমানাধিকারের মাপকাঠি হতে পারে না। অর্থাৎ, এক কথায়, কোনোরকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সংগ্রামের অধিকার তারা কেড়ে নিলেন। তাঁরা আরও জানালেন যে, যারা “প্রকৃতিসম্মত যৌনক্রিয়া” করেন আর যারা “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনক্রিয়া” করেন তারা দুটি ভিন্ন গোত্রভুক্ত (ক্লাস)। তাই এক গোত্রের সাম্যের অধিকার, অন্য গোত্র দাবি করতে পারে না। কিন্তু আইনের চোখে কেন হেটেরোসেক্সুয়াল আর হোমোসেক্সুয়ালদের ভিন্ন গোত্র হিসেবে দেখা হবে, তা তাঁরা ব্যাখ্যা করলেন না। আরো মজার ব্যাপার হল, তাঁরা এটা বুঝলেন না যে, এই গোত্রবিভাজন খুবই আপেক্ষিক। আজ যদি স্বামি-স্ত্রী দুরকমের যৌনক্রিয়া করেন তবে তাদের কীভাবে গোত্রভুক্ত করা হবে, এই রায় থেকে সেটা বোঝা গেল না। ... ...
না, আমি এখন সেক্সচেঞ্জ সার্জারির কথা ভাবিনা। আমাকে সার্জিক্যাল ছুরি দিয়ে কেটে ফেললেও আমি আমার এই গোপন কথা কাউকে বলতে পারবোনা। আমি জানি যে শরীর বদলানো সম্ভব হলে, আমি সত্যি করে একজন ছেলে হলে ভীষণ ভীষণ প্রেমিক, ভীষণ রোম্যান্টিক, ভীষণ সুখী একজন হতাম। কিন্তু, আমি কাউকে একথা জানাতে পারবোনা। হয়তো আমার মধ্যে বোল্ডনেসের অভাব আছে। ... ...
তোমার জন্য কিছুই করা হল না বাবা, কিছু কিনে দেওয়া হল না তোমায়। যে রাতে হঠাৎ তোমাদের সামনে নিজের সত্ত্বার কথা বললাম, তারপর মনে পড়ে না আর কতটুকু কী কথা হয়েছিল তোমার সাথে। পরে, মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, তুমি নাকি খুব কেঁদেছিলে! আজ তুমি থাকলে তোমাকে আর মাকে সামনে বসিয়ে আরও একবার বোঝাতাম। তুমি বুঝতে তো, বাবা! ... ...
তাহলে কেটেকুটে হাতে বাঁচল কি? একদিকে খোলা হাওয়ায় সমাজ স্বীকৃতি দিতে তৈরি হচ্ছে মত ও পথের বিভিন্নতাকে, যারা এতদিন প্রান্তে অবস্থান করতেন তাদের মূলস্রোতে মিলিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন কট্টর নৈতিক জ্যঠামশাই বা মরাল মাসিমারা। এই দুই ভিন্ন মেরুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই, কেউ চোখ খুলে বা কেউ বুজে। আর উদারতা এবং গোঁড়ামির এই বিচিত্র নকশি কাঁথার দিকে তাকিয়ে দিন গুনছি আমরা অসংখ্য গে এবং লেসবিয়ানরা ... ...
দুটো নাও ধীরে ধীরে ঢুকছে নদী থেকে সোতা খাল দিয়ে। একটার খোল জুড়ে আমড়া। আরেকটার বুকজুড়ে নারিকেল। ঘাটকুলের কাছ দিয়ে যেতে যেতে জলে ঢেউ ওঠে না। মেয়েটি হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ভাটা মাছ তোলে। কাকিলা মাছ ঘোরে ফেরে। বড়শি ফেলে মেয়েটি গাইতে থাকে- দিয়া মোরে ফাঁকি রে আমার সোনার ময়না পাখি। বাতাস প্রবল হলে সুরটা বহুদূরে উড়ে যায়। সেহাঙ্গলের ঠোঁটায় এসে সুড় সুড় করে। কড়াইগাছে একটি তক্ষক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আর বাতাস মন্দ স্পষ্ট শোনা যায়- সোনার ময়না পাখিটি উড়ে যায়। ডানার শব্দ। আর কান্নার পুরণো কম্পন। বুঝতে হলে কান থাকা দরকার। ... ...
কবে থেকে আপনি জানতে পারলেন যে আপনার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন অন্যদের থেকে আলাদা? (যেমন ধরুন ছোটবেলায় কি ধরণের খেলনা আপনার পছন্দ ছিলো সেখান থেকেই শুরু করতে পারেন।) উত্তর -- আমি ছোটবেলায় বার্বিডল নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতাম। ঠিক কবে যে বুঝতে পারলাম যে আমি একজন 'গে' তা অবশ্য মনে করতে পারবোনা। মানে, অনেক ছোট থেকেই আমি ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতাম, কিন্তু 'গে' শব্দটা তো শিখলাম আমার চৌদ্দ বছর বয়েসে। ...... ... ...
যত টাকা থাকলে সরকারী হাসপাতালে হেনস্থা হবার বিপর্যয় (বোধহয় শব্দটির ভুল প্রয়োগ হলো, কারণ এটাই সত্যি যে হেনস্থা হওয়াটাই সেখানে ঘটনা, "দুর্ঘটনা' নয়) আমাদের ঘাড়ে নিতে হত না, ততটা আর্থিক স্বচ্ছলতা আমাদের ছিলনা। ... ...
তবুও শেষপর্যন্ত আমি এইটুকু বুঝেছি যে এই মিছিল অন্তত আমার নিজের মনের মধ্যে থেকে অনেক দ্বিধাকে দূর করেছে, এল জি বি টি সমাজের অন্যান্য অংশকে স্বীকার করার, শ্রদ্ধা করার সাহস এনে দিয়েছে। ... ...
তিনদিনের প্রদর্শনীতে দ্বিতীয় দিন দ্বিপ্রহরের কিছু সংখিপ্ত চিত্র ছাড়া এই উৎসবে আমার দেখা ও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ঢুকেছিল তৃতীয় দিনের শেষ তিনটি নিবেদন। এর মধ্যে Clashing Differences ও ‘এক জগাহ আপনি’ আলোচনার পৃথক পরিসর ও প্রেক্ষিত দাবী করে, আসুন আমরা বরং দেখতে বসি ‘এক্কা দোকা তেক্কা’ - একটা বাংলা ছায়াছবি যেখানে শেষ বিন্দুতে এসে মিশে যায় বাঙালীর চেনা তিন-তিনটি আখ্যান। ... ...
মনো¢বজ্ঞানের ভাষায়, রূপান্তর কামনা এক¢ট অসুখ যাতে ¢কছ¥ মানুষ তাঁদের জন্মলব্ধ °দ¢হক নারীতÆ বা পুরুষতেÆর স® মান¢সক একাত্মতা অনুভব করেন না। ... ...
আগে আমি নিজের মধ্যে এই একটা সমকামী সত্ত্বা আছে এটা ভাবলে খুব অস্বস্তি বোধ করতাম, এমনকী চেপেও রাখতে চাইতাম, বা পারলে কোনভাবে এটা পাল্টে ফেলতে চাইতাম। আবার সমকামিতা নিয়ে কোন কথা উঠলেও আমার শুনতে খুব অস্বস্তি লাগত। ... ...